সন্তানের কাছে লেখা মায়ের চিঠি

0

মিলন কান্তি দাস :

আমার প্রিয়তম সন্তান,
আমার শুভ কামনা নিরন্তর কেবল তোমারই জন্য।
আজ বয়সের ভারে নিজের শরীরটাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না । তুমি আমার প্রথম ও একমাত্র সন্তান। বিয়ের কিছু দিন পরেই তোমার আগমনী বার্তা পেয়ে আমি ও তোমার বাবা আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম । আজকের মতো সে সময় তো জানা যেতো না ছেলে হবে না মেয়ে হবে । তুমি আসবে সে আনন্দনেই মেতে ছিলাম পরিবারের সবাই । তুমি যেদিন এলে সেদিন সারাদিন প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করছিলাম, বয়স্করা শান্তণা দিচ্ছিলেন একটু সহ্য করার জন্য । অনেক যন্ত্রণা পাওয়ার পর যখন আমার কোল জুড়ে তুমি এলে অশ্রু সজল নয়নে তোমার মুখখানি দেখে মুহূর্তে সকল যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিলাম । তোমাকে পাওয়ার আনন্দে জীবনটাই পাল্টে গিয়েছিল । তোমার বাবার সামান্য রোজগার দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হতো । সংসারও ভালো বুঝতাম না কারন খুব কম বয়সে আমার বিয়ে হয়েছিল । বিয়ের পরে সংসারের কাজ করতে গিয়ে নিজের চাওয়া পাওয়ার গুলো কেমন যেন হতে লাগলো। তোর বাবা তার সাধ্যের মধ্যে আমাকে ভালো রাখার জন্য চেষ্টা করতেন। জীবনে অনেক কিছু পেতে ইচ্ছে করতো কিন্তু এর মধ্যে তুই এলি আমার কোল জুড়ে। ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া গুলোকেও বিসর্জন দিলাম। কারন তা না হলে তোর দুধ সহ অন্য দরকারি জিনিসপত্র কিনতে তোর বাবার কষ্ট হবে । তখন ভাবতাম আমার সোনা মানিক বড় হয়ে আমার না পাওয়া সব বেদনাকে একদিন ভুলিয়ে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দেবে । মানিক তুমি যখন বিছানায় হিসু বা পটি করতে তোমার বাবা রেগে যেতেন । শুকনো জায়গায় তোমাকে শুইয়ে কতো রাত ভিজে জায়গায় ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি । এরপর যখন তুমি আমার হাত ধরে হাঁটতে শিখলে তখন আমার কি যে খুশি লাগতো । মাঝে মাঝে বাথরুমে যেতে যেতে পথেই পটি করে ফেলতে । কেউ রাগ করলে বলতে “আমার মা আছে না, সেই পরিষ্কার করবে”। মায়ের প্রতি তোমার আস্থা দেখে বিমুগ্ধ হতাম আর ভাবতাম এই ছেলে একদিন আমায় মাথায় করে রাখবে । লেখা পড়ায় বরাবরই তুমি ভাল ছিলে। পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে তোর বাবা বলতো আমাদের ছেলে একদিন মস্তবড়ো মানুষ হবে। গর্বে আমার বুকটা ভরে যেতো। তুই যেদিন স্কুল পালাতি সেদিন বাবার বকা থেকে বাঁচতে পরম নির্ভরতায় আমার আঁচলে লুকিয়ে থাকতি। এ দৃশ্য দেখে তোর বাবা হেসে ফেলত। তোর জন্য কতো মানুষের কতো কথা শুনতে হয়েছে। কিছুদিন পর কি জানি কি অসুখে ধরলো তোর বাবাকে। জমানো খুব সামান্য টাকা আর ধারদেনা করেও তোর বাবাকে ধরে রাখতে পারলাম না। তোর বাবা মারা যাওয়ার আত্মীয় স্বজনেরা তোকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কাজে দিতে বলেছিল। বলেছিল আর একটা বিয়ে করে নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে। কিন্তু তখন তুই ছিলি আমার সবটুকু জুড়ে। তোর বাবাকে ভুলে,তোকে ভুলে নিজের সুখের জন্য বিয়ে করবো এটা এক মুহূর্তের জন্য ভাবিনি। তোকে মানুষ করবো,তোর বাবার স্বপ্ন দেখা মস্তো মানুষ তৈরি করবো এটাই ছিল আমার প্রতিজ্ঞা। সে জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছি কিন্তু তোর গায়ে আচরটি লাগতে দেইনি। লেখাপড়ার প্রতিটি ধাপে তোর সাফল্য দেখে আমার আনন্দের সিমা থাকতো না । তুই যখন পুরস্কার নিয়ে আসতি আমি সেটা জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে তোর বাবাকে দেখাতাম আর বলতাম আর একটু অপেক্ষা করো দেখবে তোমার ছেলেকে আমি মস্তো মানুষ বানিয়েছি। পড়াশোনা শেষে আজ তুমি মস্তো মানুষ তৈরি হয়েছো। এখন তুমি মস্তো বড়ো চাকুরি করো। গাড়ি-বাড়ি কোন কিছুরই অভাব নেই তোর। বিয়ে করিয়ে সুন্দরী বউ এনে দিয়েছি । আমার নাতি নাতনির কল কাকলিতে মুখরিত আজ আমার ঘর। আমার সোনা মানিক বয়সের ভারে আজ নিজের শরীরটাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না ,নিজের কাজ গুলোর নিজে করতে পারছি না । বাবা আমার জন্য চিন্তা করো না স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করো আমি যেন চলতে চলতে একদিন চলে যেতে পারি তোর বাবার কাছে । আজ নিজেকে় বড় একা ও নিঃসঙ্গ মনে হয় । তুমি কর্ম ব্যস্ত মানুষ তার পরেও বলব যদি সময় পাও তবে দু দণ্ড আমার পাশে বসে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিও । তোমার কি মনে পড়ে সেই ছোট বেলায় তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে তোমার ঘুম আসতো না । আমি তোমার কাছে প্রতিদান চাইছি না । আমার বয়স হয়েছে তাই সবাইকে বলে দিও আমার কথায় কেউ যেন কষ্ট না পায়। কি বলতে কি বলে ফেলি হয়তোবা নিজেও জানি না । তোমার কাছে মিনতি আমার দুঃখ কষ্টের সময় তুমি কিন্তু আমার পাশে থেকো বাবা । আর একটা কথা আমাকে কখনও বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিও না । তোমাকে নিয়েই কেটেছে আমার সারিটি জীবন । তোমাকে দেখতে না পেলে আমি এক দন্ডও বাঁচতে পারব না । আমার কথা বা কাজে তোমার স্ত্রী বা সন্তানেরা যদি কোনও সময় রেগে যায় তুমি একটু ওদের বুঝিয়ে বলো । এখন তো আর খাওয়া দাওয়ার হিসাব বুঝি না । তাই যদি কখনও খাবার নষ্ট করি তবে ওদের রাগ করতে বারণ করো । প্রতিদিন অফিস যাওয়ার আগে এবং অফিস থেকে ফিরে পাঁচ মিনিট আমার পাশে বসো । আমি জানি তুমি ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরো তবুও একটি বার আমার পাশে এসে বসে যেও । তুমি অধিক রাতে বাড়ি ফিরে যখন জানতে চাও আমি খেয়েছি কিনা বা ঘুমিয়ে পরেছি কিনা। আমি শুনতে পাই কারন মানিক তুমি না ফিরলে মা কি ঘুমাতে পারে? তুমি অফিস যাওয়ার পর থেকে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত আমার চিন্তার শেষ থাকে না । তোমার ঘরে ফেরার শব্দ আমাকে নিশ্চিন্ত করে । যাদু আমার আমি যদি অনিচ্ছায় বিছানায় পটি বা প্রসাব করে ফেলি আমার সাথে রাগ না করে লোক দিয়ে পরিস্কার করিয়ে দিও । আজ আমি ছোট হয়ে গেছি,নিজের কাজ নিজে করার সামর্থ হারিয়ে ফেলেছি । একদিন যেমন তোমার সব কাজ আমি করে দিতাম আজ তুমি ভাববে আমি তোমার এক বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে। সবাইকে আমার সকল অপরাধ ক্ষমা করতে বলবে । তোমাকে যেমন ছোট বেলায় আদরে আদরে ভরিয়ে দিতাম আজ তুমি আমাকে তেমনি আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে । আর ধরো যদি একদমই বিছানায় পরে যাই তবে পরম করুণা ময় স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করো তিনি যেন খুব তারাতারি আমকে তার কাছে নিয়ে যান । মানিক জীবনের শেষ কটি দিন তোমাদের কাছ থেকে যেন কষ্ট না পাই । বিশেষ করে তোমার দেওয়া কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না । আমার ইচ্ছে শেষ কটি দিন আমার মাথার পাশে বসে মজার মজার গল্প শোনাবে আর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিবে ঠিক তোমার ছোট্ট বেলায় আমি যা করতাম ঠিক তেমনই করে । আর এভাবেই একদিন চলে যেতে চাই না ফেরার দেশে । তুমি ও তোমার পরিবারের জন্য পরম দয়ালু, নির্ভরতার প্রতিক পরম করুননায় স্রষ্টার কাছে তোমাদের জীবনের সুখ শান্তির জন্য প্রার্থনা করব। আমার গা দিয়ে যদি দুর্গন্ধ বের হয় তবুও তুমি আমার পাশে থেকে সরে যেও না । সোনা মানিক তুমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু তোমার মুখ দেখে হেসে ছিলাম ঠিক তেমনি আমার শেষ কটি দিন তুমি পাশে থাকলে সব যন্ত্রণা ভুলে যাবো । আমার ইচ্ছে তোমার কোলে শুয়ে,তোমারই হাতটি ধরে পরম নিশ্চিন্তে মহাকালের মহা যাত্রায় সামিল হবো। আমি জানি তোমার কষ্ট হবে তবুও আমার শেষ ইচ্ছেটুকু তুমি পুরন করো । আমার প্রিয় সন্তান আমি জানি এ চিঠি যদি তুমি পড়ো তবে আমার শেষ ইচ্ছেটা অপূর্ণ থাকবে না । তোমারই হাত ধরে পরম নিশ্চিন্তে চলে যেতে চাই পরম পিতার আশ্রয়ে ।

ইতি
তোমার জন্মদাত্রী মা

( এটি ২০১৬ সালে মা দিবসের রাত দুটো দশ মিনিট পর্যন্ত জেগে লিখেছিলাম। আজ কিছু সংযোজন বিয়োজন করে দিলাম। কোথাও কোন ভুল হলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন)

লেখক : মিলন কান্তি দাস

কলাম লেখক,সাংবাদিক, সমাজ সেবক ও শিক্ষক

Share.

Leave A Reply