স্মৃতির পাতায় ডিসেম্বর

0

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস, বিশ্বের মানচিত্রে একটি রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান শুধু নয়, এ হচ্ছে আমাদের বিজয়ের মাস, আমাদের স্বাধীনতার মাস, নতুন করে বিশ্বভুবনকে প্রত্যক্ষ করার মাস, স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার মাস। এই মাসের প্রতিটি দিন আমাদের কাছে স্মরণীয়, স্মৃতির পাতায় প্রোজ্জ্বল এবং প্রতিটি দিন ঐতিহাসিক। এই মাসে বিজয়ের আনন্দ যেমন করেছে আমাদের মনপ্রাণকে উজ্জীবিত, জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে হৃদয়কে করেছে ভাবাবেগে আপ্লুত, সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশিদের করেছে নতুন চেতনায় উদ্দীপিত, নতুন দিনের সন্ধানে বিমোহিত। ডিসেম্বরের প্রতিটি দিন ছিল উচ্ছ্বাসের মাঝে উদ্ভাসিত হৃদয়ের উৎকণ্ঠায় ভরপুর।

ডিসেম্বরের ৩ তারিখ, ১৯৭১। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা গড়ের মাঠে ভাষণ দেবেন, গোটা কলকাতায় শুধু মিছিল আর মিছিল, চলছে সবাই ময়দানে, হাতে ঝাণ্ডা, প্লেকার্ড আর ফেস্টুন, তাতে জোর দাবি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। মিছিলে মিছিলে স্লোগান হচ্ছে দেখতে চাই স্বাধীন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিতে হবে, মানতে হবে।

আমি ছিলাম স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের একান্ত সচিব। মন্ত্রী মহোদয়ের বাসায়, চম্পা কোর্টে আশু বাবুর বাড়ি, আলাপ হচ্ছে আজ কি হবে। মন্ত্রী মহোদয়কে বললাম দুপুরের পরেই আমি চলে যাব ময়দানে। সব মিছিলে আওয়াজ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেবে আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রী মহোদয় বললেন, না একথা ঠিক নয়, তিনি ময়দানে স্বীকৃতি দেবেন কেন, তা হবে ভারতের লোকসভায়। তবে তার ভাষণে আমরা কিছুটা হলেও আভাস পাব। আমি তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে চললাম ময়দানে ভাষণ শুনব বলে। সেখানে গিয়ে দেখি লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ, যেন জনসমুদ্র। মনে হলো বেশিরভাগই বাংলাদেশি শরণার্থী। কলকাতা সল্টলেকেই ছিল তখন ১ লাখের অধিক শরণার্থী, গোটা ভারতে ছিল এক কোটি। ভাষণ শোনা কঠিন হলো এই বিশাল সমাবেশের মাঝে। ঠিক করলাম বাড়িতে গিয়ে রেডিওতে শুনব। বাড়িতে গিয়ে রেডিও ছাড়লাম সত্যিই কিন্তু ভাষণ শুনতে পেলাম না। বিকাল ৫টা ৪৭ মিনিটে খবর শুনতে পেলাম পাকিস্তান বাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবস্তিপুর, যোধপুরে বিমানযোগে আক্রমণ করেছে, যুদ্ধ শুরু করেছে সোলেমানকি, খেমকারাণ, পুঞ্চ ও অন্যান্য স্থলপথে। মুহূর্তের মধ্যেই গোটা কলকাতা শহর অন্ধকার, ব্লাকআউট। শুরু হলো মহারণ। আমরা মুজিবনগরে কর্মরত ও যোদ্ধারা সবাই মহাখুশী, কারণ আমরা ছিলাম নিশ্চিত যে পাকিস্তান হবে যুদ্ধে পরাভূত, আমাদের স্বাধীনতা এবার সুনিশ্চিত।
এসে গেল ৬ ডিসেম্বর। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের লোকসভায় ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি। লিখিতভাবে এই স্বীকৃতির পত্র পাঠালেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী লিখলেন, “Government of India have decided to grant the recognition. This morning, I made a statement on this subject in our Parliament, I enclose a copy.” এতদিন ছিলাম আমরা শরণার্থী, হয়ে গেলাম বাংলাদেশি নাগরিক।

তিনদিন যুদ্ধের পরই জানতে পারলাম ঢাকার আকাশ এখন মুক্ত, পূর্বপাকিস্তানের একটি যুদ্ধ বিমানও অবশিষ্ট নেই, আকাশে উড়বে বলে। কলকাতায় কোনো ব্লাকআউট নেই, পথেঘাটে মানুষের মুখে হাসি আর যুদ্ধ জয়ের নানা গল্প। মুজিবনগরে কর্মরত আমরা সবাই প্রতিদিন সকাল-বিকাল নিত্যনতুন খবরের অপেক্ষায়, কখন দেশের মাটিতে ফিরব বিজয়ীর বেশে, ফেলে যাওয়া স্বদেশের মাটিতে।

খবর আসতে লাগল প্রতিটি ফন্টে যুদ্ধ চলছে ভয়াবহ, পালাচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা, তবে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারা বুদ্ধিজীবীদের ওপর আক্রমণ করছে, নির্মমভাবে হত্যা করছে মানুষজনকে, ভেঙে ফেলছে সকল রাস্তাঘাট, পোড়া মাটি নীতি থেকে তারা সরে আসতে পারছে না। পাকিস্তানিদের বিরাট ভরসা তাদের অকৃত্রিম বন্ধু গণচীন ভারত আক্রমণ করবে যে কোনো সময়। পাকিস্তানিদের অনেক আশা তাদের দোসর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই পাকিস্তানিদের পরাজিত হতে দেবে না। তাই হলো, নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের সৈন্যবাহিনী সপ্তম নৌ-বহর নিয়ে হাজির হলো পূর্ব পাকিস্তানের সীমানায় বঙ্গোপসাগরে, পাকিস্তানকে রক্ষা করবে বলে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেল তাদের প্রস্তুতিতে, অনেক পিছিয়ে ছিল তারা ভাবনায়। ভরসা ছিল, বাঙালি কি আর যুদ্ধ করবে, এই যুদ্ধ চলবে কমপক্ষে ২৫ বছর, বাংলা হবে আরেক ভিয়েতনাম। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না, অবরুদ্ধ পাকিস্তানিরা জীবন রক্ষার প্রয়োজনে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল অবশেষে। রমনা রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করল ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে। এই আত্মসমর্পণের দৃশ্য বাংলাদেশের জনগণের বিজয়গাথাকে ধরে রেখেছে এবং চলতে থাকবে অনাদিকাল ধরে।

প্রবাসী বাংলাদেশি মুজিবনগর সরকারের এখন দেশে ফেরার পালা। উৎকণ্ঠা কোনদিন আমরা আসব ফিরে নিজের দেশে। অবশেষে ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ অপরাহ্নে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ যাত্রা করলেন কলকাতা বিমানবন্দর থেকে ঢাকার পথে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিমান তৈরি ছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান বিমানে উঠলেন।
বিমান যাত্রীদের মধ্যে আমরা কয়েকজন সাহায্যকারী কর্মকর্তা। আমিও তার মধ্যে একজন। সবই মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন, কিন্তু সত্য। ঢাকায় বিমান এসে পৌঁছল তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বহু লোকজন, রাজনৈতিক নেতা, কর্মী এবং সরকারি কর্মকর্তারা, বিশেষ করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। বিমানবন্দরে অনেকে এসেছেন, তবে আমার এখনো মনে আছে ফরিদপুরের নেতা প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ধরে এমন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন, তাকে আর থামানো যাচ্ছিল না। অনেকেই কান্নাকাটি করছে, আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখছি এমন সময় আমার ব্যাচমেইট প্রয়াত নিজামউদ্দিন, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট, আমাকে এসে জড়িয়ে ধরল এবং কেঁদে ফেলল এই বলে যে তারা শুনেছে পটুয়াখালীতে ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে মেরে ফেলেছে। অনেকদিন চোখে জল আসেনি কিন্তু সেদিন নিজামউদ্দিনকে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম, আবার মনে হলো আমরা মরি নাই, আমরা মরণকে জয় করেছি যুদ্ধ করে।

তারপর নিরাপত্তার লোকজনদের তাগিদে মন্ত্রিপরিষদকে নিয়ে চলল মোটরযাত্রা বঙ্গভবনের অভিমুখে। ততক্ষণে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে গোটা ঢাকা শহর। তবুও রাস্তার দু’পাশে লোকে-লোকারণ্য। দু’হাত তুলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা জনগণের অভিবাদন গ্রহণ করছেন। সবার চোখে-মুখে আনন্দ, আবার উৎকণ্ঠা, কখন কি হয় কে জানে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়। কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে যাওয়ার পথেও শাহবাগ এলাকায় বহু দর্শনার্থী উৎসাহী জনতাকে পাকিস্তানি বন্দিরা গুলি করেছিল।

অবশেষে বঙ্গভবনে এসে পৌঁছলাম। রাতের খাবার খেয়ে, মন্ত্রীকে বললাম স্যার একটু বঙ্গ ভবনটা দেখে আসি চলুন। তিনি চললেন আমার সঙ্গে। সঙ্গে বঙ্গ ভবনের একজন কর্মী। আমার উদ্দেশ্য মন্ত্রীকে একটা যুদ্ধের নমুনা দেখাব। বঙ্গ ভবনের ভেতরে একটু গিয়েই বললাম স্যার দেখুন আকাশ দেখা যায়। তিনি অবাক হয়ে রইলেন, তাকালেন, বঙ্গ ভবনের ছাদ ফুটো হয়েছে অনেক জায়গায়। ভারতীয় বিমান বাহিনী যখন এখানে বোমা মারতে শুরু করল তখনই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রাও ফরমান আলী ঠিক করলেন পালাতে হবে প্রাণে বাঁচতে হলে।

সেদিন বঙ্গ ভবনের ছাদে দেখা কয়েকটি বড় বড় গর্ত, আমাদের বিজয়ের আনন্দকে আরো অনেক প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। এখন যখন ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গ ভবনে যাই, মনের অজান্তে বঙ্গ ভবনের ওপর যৌথ বাহিনীর আক্রমণের কথা মনে পড়ে বারবার। বিজয়ের আনন্দে ভরে উঠে মনপ্রাণ। আমরা করেছি জয়।

লেখক: সাবেক সচিব

Share.

Leave A Reply